সাধারণ মানুষ নিজেকে দেখে, নিজের চারপাশকে দেখে, কখনো কখনো নিজের ভেতরেই হয়তো হারিয়ে যায়। কিন্তু সৃষ্টিশীল মানুষের পর্যবেক্ষণের প্রকৃতি ভিন্ন। কারণ তার নিজের অস্তিত্ব একক কোনো উপলব্ধির ক্ষেত্র নয়। ব্যক্তির জীবন, পরিবেশ-পরিস্থিতির ক্রমায়াত পথযাত্রা এবং বিশ^ায়নের প্রভাবশালী ভূমিকায় ব্যক্তির নিঃসঙ্গতার আনন্দের ভূখÐও এখন হারিয়ে গেছে। সকলকে নিয়ে, নিজের অতীত ও বর্তমানের যন্ত্রণাকে নিয়ে এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নযাত্রার উপলব্ধিতেই লেখকের আত্মসন্ধান একালে তাৎপর্য খুঁজে ফেরে। নিলুফা আক্তার তাঁর উপন্যাসে জীবন পর্যবেক্ষণ ও রূপায়ণের ক্ষেত্রে চরিত্রচিত্তের যন্ত্রণা ও রক্তক্ষরণের পাশাপাশি তাঁর স্মৃতি উপলব্ধি ও সম্পর্কের মানুষদের অন্তর্জগতকেও উন্মোচন করেছেন। বিশ^যুদ্ধোত্তর নিরীক্ষামূলক উপন্যাসগুলোতে ব্যক্তি প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে চরিত্রপাত্রের অনুসন্ধান ছিল অতলান্তিক। একবিংশ শতাব্দীর সর্বগ্রাসী যুদ্ধ যতটা না বহির্জাগতিক তার চেয়ে অনেক বেশি অন্তরাশ্রয়ী; নিলুফা আকতারের ‘অতলান্ত খোঁজ’ পাঠককে সেই যুদ্ধযাত্রারই পথ দেখায়।
এক অবদমিত জীবন তৃষ্ণা আর অপ্রতিরোধ্য মৃত্যু-ভয়ের ঠিক মধ্যখানে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর উপন্যাসের মানুষগুলো। জন্ম, মৃত্যু আর যাপিত জীবন-এই ত্রিলোকের ঘর-মন-জানালার সত্য উদ্ঘাটনে নিমগ্ন লেখক ‘নিলুফা আক্তার’-এর জন্ম ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া এই ত্রিনদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত ‘চাঁদপুর’ শহরে। বাবা মরহুম আবদুল হাকিম পেশায় আইনজীবী ছিলেন। মা মনোয়ারা বেগম প্রাক্তন স্কুল শিক্ষয়িত্রী। পড়াশোনার শুরু চাঁদপুর মিশন স্কুলে। ১৯৮৬ সালে মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং ১৯৮৮ সালে চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন। ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ সিলেট সরকারি এমসি কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স পাস করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ওই একই বিষয়ে এমএ, ২০০৫ সালে ওই বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌরেন বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে ‘বনফুল’-এর উপন্যাস নিয়ে এমফিল ও ২০১৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
স্কুলজীবনেই তাঁর লেখালেখির ‘হাতেখড়ি’। সমকালে চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘নির্ঝর’, ‘নির্ভীক’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কবিতা লিখতেন। সিলেটের সুপ্রাচীন পত্রিকা ‘দৈনিক যুগভেরী’-এর শিশুবিষয়ক পাতা ‘আঁকা ও লেখা’-এর বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। ’৯০-এর দশক থেকে তিনি ‘সিলেট লেখিকা সংঘ’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৯৯৯ সালে সিলেট লেখিকা সংঘ থেকে প্রকাশিত ‘শুচি’ গল্পগ্রন্থে, ত্রয়ী গল্প নিয়ে গল্পকার হিসেবে তাঁর আবির্ভাব। লেখকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি শুধু’ ২০০৯ সালে পলল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী মো. তারেক আবু তাহের সিলেটের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং দুই ছেলে, এক মেয়ে নিজ নিজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত।
কল্যাণীয় নিলুফা আক্তার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। পাশাপাশি সৃষ্টিশীল সাহিত্যরচনায় সে একনিষ্ঠ। ‘অতলান্ত খোঁজ’ তার প্রথম উপন্যাস। রচয়িতার বাস্তব পর্যবেক্ষণের সঙ্গে কল্পনাশক্তির সার্থক যোগে এই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে। এতে মানবজীবনের, বিশেষত নারীজীবনের, নানা উত্থানপতনের চিত্র ধরা পড়েছে। সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ্বসহযোগসংঘাত এতে রূপায়িত হয়েছে। তার মধ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছে জীবন সম্পর্কে তিক্তমধুর উপলব্ধি, গতানুগতিক জীবনাচরণকে অতিক্রম করে এক নতুন ভাবনার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছোবার চেষ্টা। লেখক একই সঙ্গে মেধাবী ও পরিশ্রমী। বইটির প্রকাশভঙ্গির মধ্যেও আছে নিজস্বতার প্রগাঢ় ছাপ। এই বইয়ের প্রকাশ-উপলক্ষে আমি তাকে অভিনন্দন জানাই। আশা করি, ‘অতলান্ত খোঁজ’ পাঠকের সমাদর লাভ করবে।
(আনিসুজ্জামান, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
Reviews
There are no reviews yet.
Be the first to review “অতলান্ত খোঁজ” Cancel reply
Reviews
There are no reviews yet.