প্রবন্ধসংকলন (অশোক মিত্র)

অর্থনীতিবিদ ডক্টর অশােক মিত্রর প্রথম বাংলা প্রবন্ধের বই সমাজ সংস্থা আশা নিরাশা বেরিয়েছিল আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে, সেই থেকে এ-পর্যন্ত বাংলায়। বেরিয়েছে আরাে সব বই : কবিতা থেকে মিছিলে, সংকটের স্বরূপ, অচেনাকে চিনে চিনে, প্রতিদিনের কথা, হ্রস্ব-দীর্ঘ, পটভূমি, নাস্তিকতার বাইরে, অকথাকুকথা, সকলই তােমার ইচ্ছা এবং এ-বছর অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত গ্রন্থ তালবেতাল। কোনাে-কোনাে রচনার আপাত উপলক্ষ ছিল কোনাে সমসাময়িক ঘটনা বা সংকট, যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়ানাে ছিল রাজনীতি ও অর্থনীতি; আবার অন্যান্য রচনার সাময়িক উপলক্ষ যা-ই হােক না কেন সেগুলি ছিল শিল্প, সাহিত্য বা সংস্কৃতি বিষয়ক। কিন্তু সত্যি কি এমন-কোনাে স্পষ্ট বিভাজন টানা যায় অশােক মিত্রর রচনায়? সংস্কৃতির যা ব্যাপকতর অর্থ তা থেকে রাজনীতি অর্থনীতি অথবা সাহিত্য শিল্প বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া যায় না। অন্তত অশােক মিত্রর রচনায় যায় । কেননা বৃহত্তর অর্থে এরা সবাই পরস্পরের সঙ্গে আদ্যন্ত সম্পৃক্ত- যেহেতু তাদের মধ্যে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে লেখকের জীবনদর্শন- যেটা সমস্তকিছুকে জড়িয়ে। এই সংকলনে পূর্বোক্ত বইগুলাে থেকে বেছে নিয়ে প্রবন্ধগুলি বিন্যস্ত হয়েছে দুটি পৃথক ভাগে— অথচ তাদের বলবার কথা এমনই পরস্পর সংলগ্ন যে তাদের একসঙ্গে পড়ার মধ্যে আছে সেই জীবনদর্শনেরই সংস্থান। এই প্রায় চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাসে এক ক্রমবর্ধমান সংকটেরও কাহিনী কিন্তু সংকটই এই কাহিনীর শেষ কথা নয়, যেহেতু তার মধ্যে সর্বক্ষণ জেগে থাকে কোনাে সংবেদনশীল হৃদয়ের জাগ্রত চৈতন্যও বিবেক, যা শেষ পর্যন্ত সব দীৰ্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যেও দুর্মর এক আশাবাদে স্পন্দিত হয়ে ওঠে। অশােক মিত্রর গদ্যের পরিশীলিত দীপ্তি ও তীক্ষ্ণতা আদৌ আবেগবিহীন নয়, সমস্ত শ্লেষ-কৌতুক-পরিহাসের মধ্যে উদ্বেল ও মথিত হয়ে ওঠে অনুভূতি, আর বিস্মরণবিমুখ ব’লেই সমসাময়িকতাকে অতিক্রম করে পৌছে যায় অন্য কোনাে জাগরণের স্তরে, মাখামাখি হয়ে যায় বাস্তবের সত্যে আর কল্পনার স্বপ্নে—আর আর্ত লাঞ্ছিত বিপন্ন বিশ্বে তবুও সার্থকতার স্বপ্ন দ্যাখে, তবুও আস্থার বাণী শােনায়। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে এই সংকলন ঈর্ষণীয় সংযােজন।