বাংলার রেনেসাঁস ও লালন ফকির

লালন ফকির বাউল সম্রাট, মরমি গীতিকবি এমনি নানা অভিধায় অভিহিত। এর কোনােটিকেই অস্বীকার করেও বলা চলে লালন একজন উচ্চমার্গের। দার্শনিক ও সমাজচিন্তক। উনিশ শতকের মতাে বদ্ধ সমাজে বসে তিনি নানা সামাজিক কুপ্রথা এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। আজীবন। তার সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজমানুষের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তি। লালন সমাজের নীচুতলার অন্ত্যজ শ্রেণির নেতা। লালন ফকিরের সমাজ হাজার বছর ধরে অন্ত্যজ। শ্রেণিকে ঊনমানবে পরিণত করে রেখেছিল। নানা। সামাজিক শ্রেণি, প্রথা ও শােষণের জাতাকলে পড়ে নীচুতলার এই মানুষগুলাে কখনােই জীবনের স্বাদ। ভােগ করতে পারেনি। লালন তাই প্রথমেই সমাজের এই শ্রেণি, প্রথা এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ প্রতিবাদ করেছেন, সব মানুষকে সমানজ্ঞানে বিচার করে মানুষের ভেতরের সুপ্ত মানুষকে জাগিয়ে তােলার গান গেয়েছেন। উনিশ শতকের সবচেয়ে। শক্তিশালী সামাজিক প্রথা জাতিভেদ প্রথাকে লালন। তার জীবনযাপনে এবং জীবনদর্শনে অগ্রাহ্য করেছেন, বলেছেন জাতিভেদ প্রথা সমাজের সৃষ্টি। তাই । সমাজমানুষকে মুক্তির স্বাদ দিতে হলে এই সমাজকেই বদলাতে হবে। লালন ফকিরের সংগ্রাম তাই যথার্থ অর্থেই সমাজ বদলের সংগ্রাম সমাজের শােষিত মানুষকে তাদের অধিকারসচেতন করে তােলার সংগ্রাম। সে সংগ্রামের হাত ধরেই বাংলায়, বিশেষ করে গ্রামীণ বাংলায় নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটে। কলকাতাকেন্দ্রিক নাগরিক সমাজে রাজা রামমােহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরােজিও প্রমুখ প্রাতিস্বিক ব্যক্তিত্ব নাগরিক মানুষকে নতুনভাবে জাগিয়ে তােলার জন্য নানা ধরনের সংস্কার আন্দোলন করে ইতিহাসে ঠাই পেয়েছেন। কলকাতার সেসব নাগরিক আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সমাজের উচ্চশিক্ষিত হিন্দু শ্রেণির জাগরণ। বৃহত্তর মুসলিম সমাজ সেসব আন্দোলনের সুবিধাভােগী ছিল না। সেসব শহুরে আন্দোলন গ্রামাঞ্চলে তাে নয়ই, এমনকি কলকাতা শহরের। আশপাশের নিম্নবর্ণের হিন্দু সমাজেও তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু লালনের সামাজিক সংগ্রাম চরিত্র-বৈশিষ্ট্যে ছিল অনেকটাই সর্বজনীন। সমাজের সব মানুষের আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক মুক্তি ছিল। লালন ফকিরের আন্দোলনের প্রত্যক্ষ লক্ষ্য। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে লক্ষণীয়, আমাদের সামাজিক ইতিহাসে লালন ফকির। সেভাবে মূল্যায়িত নয়। বিশেষ করে তার সামাজিক আন্দোলন ইতিহাসের অন্তরালেই রয়ে গেছে। বর্তমান গ্রন্থে লালন ফকিরের সামাজিক আন্দোলন বিশ্লেষণ করে বাংলার রেনেসাসে তার। আন্দোলনের গুরুত্ব ও অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করছি, বর্তমান গ্রন্থ পাঠে। পাঠকগণ বাংলার মরমি চিন্তক লালন ফকিরকে। নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারবেন।