বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ১০-এ ৪টি গ্রন্থ সংকলিত হলো – বামপন্থী মহলে অনৈক্য ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবী ঐক্য প্রসঙ্গে (উমর ১৯৯১), নব্বুইয়ের নাগরিক বুর্জোয়া অভ্যুত্থান ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (উমর ১৯৯২ ক), প্রতিবিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ (উমর ১৯৯২ খ)এবং ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে (উমর ১৯৯৪ ক) ।
বামপন্থী মহলে অনৈক্য ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবী ঐক্য প্রসঙ্গে (উমর ১৯৯১) গ্রন্থের মুখবন্ধে এরশাদ সরকার পতনের পর (ডিসেম্বর ১৯৯০) তৎকালীন সমাজের শ্রেণী সম্পর্ক নিয়ে উমর আলোকপাত করেছেন, “সাম্রাজ্যবাদ, ভূমি মালিক, শিল্প, ব্যবসা ও ব্যাংক বীমা মালিক, সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক সম্পর্ক ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এখনো পুরোদস্তুর শক্তিশালী রয়েছে।” (উর:১০:১৪) সে সময়ের গণ-অভ্যুত্থান বিষয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ রয়েছে, “বিগত অক্টোবর-ডিসেম্বর আন্দোলনের মাধ্যমে যে পরিবর্তন ঘটেছে সে পরিবর্তন কোনো সংসদীয় পথে অথবা নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটেনি। তা ঘটেছে একটি নাগরিক বুর্জোয়া অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের শক্তির যে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে সেই শক্তিই ভবিষ্যতে আরও ব্যাপক আকারে সংগঠিত হয়ে জনগণের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক শত্রুদেরকে এদেশের মাটি থেকে উৎখাত করে একটি বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধন করবে।” (ঐ) এ পটভূমিতে বামপন্থীদের ঐক্য আন্দোলনের বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। কিন্তু এখানে এ ঐক্য মূলকথা নয়। মূলকথা হলো, ‘স্বাধীন উদ্যোগে নোতুনভাবে বিপ্লবী রাজনৈতিক স্রোতধারা সৃষ্টি করা’ (উর:১০:৭৮)। বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ ও নিজস্ব বোঝাপড়ার জন্য গ্রন্থটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে আমরা মনে করি।
নব্বুই-এর নাগরিক বুর্জোয়া অভ্যুত্থান ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (উমর ১৯৯২ ক) গ্রন্থে সঙ্কলিত প্রবন্ধগুলির আলোচ্য বিষয় হলো Ñ “সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের সবলতার দিকগুলোর সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ ও বামপন্থী বুর্জোয়াদের এবং তাদের জোটগুলোর জনস্বার্থবিরোধী অবস্থান এবং তৎকালীন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা, তাকে সঠিক পথ চালনার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ইত্যাদি ...।” (উর:১০:৯৯)। তাছাড়া অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী দলগুলোর ভূমিকা সত্ত্বেও পরিণতির দিকটি আশাপ্রদ না হবার কারণগুলি ব্যাখ্যা করেছেন উমর যা প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারাকে শক্তিশালী করার জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
প্রতিবিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ (উমর ১৯৯২ খ) গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পর্কে উমর লিখেছেন – “পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার উপর আলোচনা করা হয়েছে। ঐসব অঞ্চলের দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ এবং সাম্রাজ্যবাদীদের পারস্পরিক যোগসাজশ ও সহযোগিতার মাধ্যমে কীভাবে পুঁজিবাদের আনুষ্ঠানিক ও পূর্ণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে সেগুলি বিশেষভাবে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।” (উর:১০:২২৫) পৃথিবীতে যখন ভূরাজনীতির গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন তা পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আলোচ্য গ্রন্থে প্রকাশিত চিন্তাগুলি গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া বাঙলাদেশের রাজনীতিতে কীভাবে পড়েছে সে বিষয়ে এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে।
এ খণ্ডে সঙ্কলিত সর্বশেষ গ্রন্থটি হচ্ছে, ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে (উমর ১৯৯৪ ক)। এ গ্রন্থে উমর বিশ^জোড়া ধর্মীয় এবং অন্যান্য প্রতিক্রিয়ার উত্থানের তাৎপর্য আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে ‘সমাজতান্ত্রিক’ নামে পরিচিত রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের পর বিশ^জুড়ে প্রতিক্রিয়ার নবউত্থান শুরু হয়েছে। আসলে এ ধারা শুরু হয়েছিল সত্তরের দশক থেকে। ইরানের তুদেই পার্টি (কমিউনিস্ট পার্টি), মিশরের কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি পার্টির উপর সেসব দেশের সরকার কর্তৃক নির্যাতনের সম্মুখে পার্টিগুলির ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সাথে এসব দেশের সরকারের সাথে তৎকালীন রুশ সরকারের সম্প্রীতির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। জার্মানীর নাৎসী পার্টি শক্তি বৃদ্ধি করেছে। আলজিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে এবং ইউরোপের কিছু দেশে ধর্মীয় শক্তি অধিক শক্তিশালী হয়েছে। ধর্মীয় শক্তির সাথে সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিও জোরদার হয়েছে। একইভাবে বাঙলাদেশেও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া, উগ্রজাতীয়তা এবং অন্যান্য প্রতিক্রিয়া বিকশিত হয়েছে। (উর:১০:৩৭০-৭৪) উপরের বিষয়গুলির ধারাবাহিকতায় এ গ্রন্থে বাঙলাদেশে জামাতে ইসলামীর প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি নিয়ে অনেকগুলি রচনা সঙ্কলিত হয়েছে, যেখানে জামাত-ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাস; গোলাম আজমের নাগরিকত্ব, যুদ্ধাপরাধ ও মুক্তি; পাকিস্তানে নির্বাচনে জামাতের শোচনীয় পরাজয় ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে।
বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ১০-এ সঙ্কলিত গ্রন্থগুলি দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের জন্য অন্যতম সহায়ক শক্তি – একথা বদরুদ্দীন উমরের সকল রচনাবলীর জন্যও প্রযোজ্য।