অলঙ্কার-অন্বেষার শুরু প্রায় একযুগ আগেএবং সবিনয়ে স্বীকার করছি, আজও আমি অন্বেষা-পর্বে, সিদ্ধি এখনও অনায়ত্ত। অনাদিকালের অনির্বাণ কাব্যসৌন্দর্যের প্রতি প্রবলতর আকর্ষণ আমাকে এ দুঃসাহসিক কর্মে ব্ৰতী করেছে। প্রায় দুবছর নিরলস শ্রমে ও প্রেমে আমি এ-কাজে একান্তভাবে নিবেদিত। তবু আমার লালিত পরিকল্পনার সার্বিক রূপায়ণ এ সংস্করণে সম্ভব হয়নি; কেবল অলঙ্কারের ইতিহাস, শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কারে আলােচনা সীমাবদ্ধ রয়েছে। আগামীতে রস, রীতি, ধ্বনি সহ সংকর অলঙ্কার ও আধুনিক বাঙলা কাব্যে পাশ্চাত্য অলঙ্কারের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে আলােচনা করার ইচ্ছে আছে। অলঙ্কার-অন্বেষার গৃহীত পরিভাষা, শ্ৰেণী-বিভাজনে এবং বিশ্লেষণ-পদ্ধতিতে সর্বাধিক। প্রচলিত ও যুক্তিগ্রাহ্য মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এবং বিতর্কিত বিষয়েসমূহের জটিল তাত্ত্বিক ব্যাখায় না গিয়ে মূল ভাষ্যকে যথাসম্ভব সহজবােধ্যভাবে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। অলঙ্কারশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রে স্বীকার করবেন—কাব্যসৌন্দর্য-বিজ্ঞান (Aesthetics of poetry) বিশাল ও ব্যাপক, কাব্য-বিচারের পথ ঋজু ও বঙ্কিম, তাঁর আস্বাদন বা উপলব্ধিতেও মাত্রাভেদ অনিবার্য। বিশেষ করে অর্থালঙ্কারে যেহেতু রূপ’ নয় ‘স্বরূপ’ আন্তরস্থিত অর্থ বা ‘চিরূপই’ নিয়ন্তা, সেজন্যে অলঙ্কার চিহ্নিতকরণে মতভেদের অবকাশ বর্তমান।
এ গ্রন্থে শ্রদ্ধার সঙ্গে পূর্বসূরীদের মতামত বিচার করা হয়েছে। যদি তাদের সিদ্ধান্তকে কোথাও অযৌক্তিক বলে মনে হয়েছে, সেখানে আমি তার কারণ উল্লেখ করেছি এবং আমার মতের সপক্ষে প্রমাণ হাজির করেছি—যাতে বিদগ্ধ পাঠক সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। অলঙ্কার-অন্বেষা প্রাচীন পণ্ডিতদের বিচারের সপ্তম বেদাঙ্গ’ও নয় কিংবা সংস্কৃত ভাষায় খ্যাতিমান মনীষীদের উচ্চাঙ্গের গবেষণাসমৃদ্ধ কোনাে অনুপম কাব্যসৌন্দর্য-বিজ্ঞানও নয়, অথবা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যপূর্ণ কোনাে কাব্যতত্ত্ব নয়। এটি মূলত একজন সহৃদয় কাব্য-পাঠকের সংবেদনশীল কাব্য-বিচারের প্রচেষ্টামাত্র। বাঙলা ভাষায় রচিত সমস্ত অলঙ্কারগ্রন্থের ধারায় আমার এ অলঙ্কার-অন্বেষা কোনাে ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা বলে আমি দাবি করছি না, তবে কিছু বিষয়ে আমি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছি।
প্রথমত, প্রায় সমস্ত অলঙ্কারগ্রন্থে বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষার অনুবাদ দেয়া হয় না, কারণ ঐ সমস্ত গ্রন্থ-প্রণেতার বিশ্বাস, যাঁরা অলঙ্কারশাস্ত্রের চর্চা করেন বা পড়েন তাঁরা সকলেই সংস্কৃত জানেন; এটা পশ্চিম বাঙলার অধিকাংশ পাঠকের ক্ষেত্রে সত্যি হলেও আমাদের দেশের বাঙলা কাব্যপাঠকের বেশিরভাগই সংস্কৃতজ্ঞ নন, ফলে উদ্ধৃত বৈদিক বা সংস্কৃতের অনুবাদ প্রাঞ্জল ভাষায় দিতে চেষ্টা করেছি যাতে প্রাচীন অলঙ্কারের ঐতিহ্যে আমাদের মানসিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয়ত, প্রায় সব অলঙ্কারবিদ উদাহরণ সগ্রহের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত, খুব বেশি হলে নজরুল ইসলাম কিংবা সত্যেন দত্তের কাব্য পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছেন। আমি এ-ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথায় সমর্পিত নই, কারণ শুধু প্রতিষ্ঠিত কবির সৃষ্টি-শরীরের অলঙ্কার বিচার নয়, সাম্প্রতিক কবিকর্মে অলঙ্কার নির্ণয়ের চেষ্টা করেছি। তাই বাঙলাদেশের সমকালীন বহু কবির সৃষ্টি থেকে উদাহরণ গ্রহণ করেছি। অবশ্য আমার এ গ্রহণ তাঁদের কবি-কৃতির তুলনামূলক কোনাে মূল্যায়ন নয়। আমি সচেতন যে, বাংলাদেশের বহু প্রতিষ্ঠিত কবির কাব্যে বিরল অলঙ্কার বর্তমান, আগামীতে সেগুলাে সংগ্রহ করতে প্রয়াস পাব; এবং কথাসাহিত্য থেকেও উজ্জ্বল উদাহরণ গ্রহণের প্রচলিত ধারা বদলাতে চেষ্টা করব।