বাঙালি মুসলমানের সমাজ-সংস্কার ও সমাজ-জাগরণের কাজ শুরু হয় সভা-সমিতি, সাময়িকপত্র, সাহিত্যকর্ম—নানা মাধ্যমে। খুব স্পষ্ট বা পদ্ধতিমাফিক না-হলেও মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রসঙ্গও সেখানে শামিল হয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকেই এর সূচনা। তবে সংগঠিত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হয়তো নয়, তখন এই ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা-চেতনা ছিল মোটের উপর ব্যক্তিগত একক প্রয়াসের ফসল। এমন মুক্ত, স্বচ্ছ ও উদার মননচর্চার ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি হিন্দুর জাগরণের দৃষ্টান্ত ও নানা মনীষীর আদর্শিক প্রেরণায় ১৯২৬ সালে ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর জন্ম।
এই ‘সাহিত্য সমাজ’-এর মূলমন্ত্র ছিল— “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।” মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও সামাজিক জাগরণ ছিল এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ও প্রয়াস। ‘শিখা’ ছিল এই সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র। ‘সাহিত্য সমাজ’ অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল বারো বছর (১৯২৬–১৯৩৮), আর শিখা-র সাকল্যে পাঁচটি খণ্ড (১৯২৭–১৯৩১) প্রকাশিত হয়। মাত্র এই ক’টি সংখ্যাতেই ‘সাহিত্য সমাজ’-এর চেতনা, কর্মসাক্ষ্য ও সাহিত্যপ্রয়াসকে ধারণ করেছে এই পত্রিকা। তাই ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এ এই পত্রিকার মূল্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। শিখা শুধু একটি সংগঠনের মুখপত্র নয়, এই পত্রিকা মুক্তবুদ্ধি চর্চার এক মূল্যবান সামাজিক-সাংস্কৃতিক দলিলও বটে।
মূল শিখা পত্রিকা এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্যই বলা চলে। তাই সম্পূর্ণ শিখা পত্রিকার প্রতিলিপি (facsimile) সংস্করণ প্রকাশের আলাদা গুরুত্ব ও আবেদন আছে। এই বিবেচনা থেকেই শিখা-র প্রতিলিপি-সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ। অনুসন্ধিৎসু গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত পাঁচ খণ্ডের শিখা সংকলনের শেষে পরিশিষ্ট-পর্যায়ে সংযোজিত হয়েছে বেশ কিছু দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য তথ্যদলিল। এই মূল্যবান উপকরণ শিখা-র মূল্যায়ন ও পর্যালোচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।