স্বনির্বাচিত গল্প (গতিধারা)

অচেনা ছিলনা সবটুকু, কিন্তু রৌদ্রলােকে খােলা ইস্পাত তরবারির ঝকমকির মত ছােটগল্পমালা নিয়ে যখন আলাউদ্দিন আল আজাদের প্রথম সােচ্চার আত্মপ্রকাশ তখন উভয় বাংলার সুধীসমাজ চমকিত হয়েছিলেন, তার প্রমাণ। আছে। তারা স্বাগত জানিয়েছেন, জানিয়েছেন অভিনন্দন। সে বইয়ের নাম জেগে আছি (জানুয়ারি ১৯৫০)। প্রচ্ছদটা অভিনব। ইটরং দেয়াল, তার মধ্যে সাটানাে পােস্টার, এই নাম। কাঠখােদাই করে দিয়েছিলেন লেখকের বন্ধ আজকের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলাম। ট্রেডল মেশিনে চার পৃষ্ঠা করে ছাপা হয়েছিল এই বই, সবটাই যেন ছিল। বৈপ্লবিক। দৈনিক সত্যযুগ পত্রিকার গ্রন্থ পরিচয় বিভাগে শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন : বিনাদ্বিধায় স্বীকার করতে পারি, জেগে আছি সাম্প্রতিক মুসলিম সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গল্পগ্রন্থ এবং সমগ্রভাবে বাংলাসাহিত্যের অন্যতম সেরা বই (সত্যযুগ, রবিবার ১২/৬/৫০)। ঢাকার সদ্য প্রকাশিত সাহিত্যপত্র মুক্তির রিভিয়ুতে মন্তব্য করা হল : এখান থেকেই আমাদের যাত্রা হল শুরু। কিছুকাল পরে চট্টগ্রামের প্রবীণ সাহিত্যিক মােমেনের জবানবন্দীর রূপকার মাহবুবুল আলম কথা প্রসঙ্গে মহান লেখক আবুল ফজলকে বলেন : তার ধানকন্যা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। মনে হয়েছে। এ এক নতুন জ্যোতিষ্ক সমগ্র গগনে যাকে পথ ছেড়ে দিতে হবে। এমন স্বচ্ছ ও সুন্দর প্রকাশভঙ্গি কোন লেখকেরই নয়। ঊষার শুভ্রতা তার দৃষ্টিতে, উদীয়মান সূর্যের লালিমায় কী প্রচণ্ড শক্তির পূর্বাভাষ অথচ কি অদ্ভুত সংযম! (দৈনিক আজাদ ২০/১২/১৯৫৩)। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদই আমাদের পঞ্চাশের প্রথম কথাশিল্পী। ব্রহ্মপুত্র মেঘনা যমুনা ধলেশ্বরী-বিশাল জনপদের যে বিচিত্র জীবনধারা, মানুষের জীবনের বিরুদ্ধে পারিপার্শ্বের ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ একজন সমাজমনস্ক শিল্পী হিসেবে তাঁকে গঠন করেছে। পঞ্চাশের শেষদিক, তার গল্পের শিল্প ভাবনা রুপান্তর লাভ করে-এ পর্যায়ে মানবমনের অন্তর্বিশ্লেষণ ও ফ্রয়েডীয় যৌনতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত করেছেন জীবনকে। কিন্তু তাই বলে অস্তিত্ববাদ, পরাবাস্তবতা কি অন্ধ কুটৈষণা যা নিয়তির মত তাঁর ছােটগল্পের সূক্ষ্ম কারুকাজে ধরা দেয়নি, তাও নয়। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের বাস্তবতা, নিবিড় বিষয় বৈচিত্র্যের বাইরে আজাদের শিল্প চেতনার যে অতিরিক্ত বিশেষত্ব চোখে পড়ে তা হচ্ছে কাব্যময় ভাষা, বর্ণনার শিল্পমাধুর্য এবং বাক্যবিন্যাসের চমৎকারিত্ব। তার ছােটগল্প কখনাে জামদানি, কখনাে মসলিন। তাছাড়া বাংলার মাটির ভাষার এমন উর্বর ও সুন্দর ব্যবহার সমকালের আর কোন লেখকের গল্পেই আমরা খুঁজে পাই না। তাঁর গল্পে কোনাে তত্ত্ব কিংবা দর্শন আরােপিত হয়না, কেবল সত্য জুলে উঠে দীপশিখার মত। জীবন নিজেকে প্রকাশ করে। সেজন্য এসব গল্প সমাজ বিকাশেরও সূচিপত্র । । উপসংহারে এটুকু বলা যায়, আদি শ্রেষ্ঠগল্পের বাইরের গল্পমালা থেকে বাছাই করে এ সংগ্রহ তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং দুটো গ্রন্থ পরস্পর সম্পূরক ।